• বুধবার ২৩ অক্টোবর ২০২৪ ||

  • কার্তিক ৭ ১৪৩১

  • || ১৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

উপদেষ্টা পরিষদে এনজিও প্রাধান্য: চ্যালেঞ্জ, চাপ ও প্রত্যাশা

আজকের টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ১২ আগস্ট ২০২৪  

কোটা আন্দোলন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। নানা নাটকীয়তার মধ্যে সেদিনই দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরই ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন আলোচিত নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের মধ্য দিয়ে গত ৮ আগস্ট রাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যাত্রা শুরু করে।
দেশের সব স্তরের মানুষ ও বিভিন্ন মহল এই উপদেষ্টা পরিষদকে ইতিবাচকভাবেই গ্রহণ করে। তবে অনেকেই এই পরিষদকে ‘এনজিও’র প্রাধান্য পরিষদ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ, ১৮ জনের পরিষদে অন্তর্ভুক্ত ছয়-সাতজনই বিভিন্ন এনজিওর সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেককে এই পরিষদকে ‘এনজিও গ্রুপ অব বাংলাদেশ’ নামে আখ্যায়িত করতে দেখা গেছে!

গত ৮ আগস্ট এই সরকারের যাত্রা শুরুর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ব্যক্তি নানা মত, বিশেষ করে এনজিওর বিষয়টি সামনে আনেন। সাংবাদিক সাজেদা হক লেখেন- ‘এনজিও গ্রাম হয়ে যাবে এবার। উপদেষ্টা সাতজন এনজিও থেকে। নতুন প্রজেক্ট বাংলাদেশ।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আপডেট- নামকটি একটি পেজে মো. নাঈমুর রহমান নামে এক ব্যক্তি পোস্ট করেন- ‘এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে এনজিওদের এত আধিপত্য থাকার কারণ কী? তিনি আরো লেখেন- আন্দোলনের মাঠের অনেক স্টেক হোল্ডারদের এখনো মূল্যায়ন করা হয়নি, যাদের ঐক্যবদ্ধ চেষ্টায় স্বৈরশাসকের পতন হয়েছে। অথচ এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের অনেকেই পুরো সময়জুড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিষ্ক্রিয় থাকার পরও পরিষদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।

রাকিব আহসান খান নামে একজন লিখেছেন- ‘উপদেষ্টা পরিষদে অন্তত ছয়জন এনজিও অ্যাকটিভিস্ট আছে, যার মাঝে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস নিজেও একটি এনজিওর প্রধান।’

হারুন জামিল নামে একজন পোস্ট করেন- ‘আমলাতন্ত্র, সেনাবাহিনী, পুলিশ প্রশাসনের প্রতিনিধি প্রয়োজন ছিলো। বেশি এনজিও প্রতিনিধি দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে। এখন অপেক্ষার পালা।’

এ রকম বহু মানুষ এনজিওর বিষয়টিকে সামনে এনে তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন। উল্লেখ্য, এই পরিষদে কোনো রাজনীতিবিদ নেই, নেই কোনো আমলা বা প্রশাসনিক কেউ। ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে- এনজিওর সঙ্গে সম্পৃক্ত এই উপদেষ্টারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো কি কার্যকরীভাবে সামলাতে পারবেন, যদিও তারা প্রত্যেকেই দক্ষতায় তারা নিজ নিজ জায়গায় সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। এমতাবস্থায় সামনের দিনগুলোতে তারা কী করেন, কোন পদ্ধতিতে দেশকে বা তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে নেন সেটিই দেখার বিষয়।

নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করা এই সরকারের উপদেষ্টাদের দক্ষতা ছাপিয়ে এখন তাদের সামনে জাতির প্রত্যাশাই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের সামনে অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জ আছে। আবার তাদের সামনে নতুন নতুন অনেক চাপও তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে সমন্বয়পূর্বক কৌশলগতভাবে সব চ্যালেঞ্জ ও চাপ মোকাবিলা করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে তাদের।

অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারের সামনে এখন সব থেকে বড় চাপ রাজধানীসহ দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। দল-মত নির্বিশেষে সব মানুষের মধ্যে থাকা সব ধরনের ভয়-আতঙ্ক দূর করা। প্রতিটি থানায় স্বাভাবিক কার্যক্রম নিশ্চিত করা। দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। সবার অধিকার নিশ্চিত করা। জনগণের ক্ষোভ প্রশমন করে তাদের যার যার কাজে নিয়োজিত করা। দ্রুত স্কুল-কলেজ খুলে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে নেয়া। দেশের ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো ঠিক করা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কমিয়ে আনা। সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে যথা সময়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আস্থা তৈরি করে তাদের নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করা।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। উপদেষ্টা পরিষদে আরো আছেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, মানবাধিকার সংগঠক আদিলুর রহমান খান, সিনিয়র আইনজীবী হাসান আরিফ, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন, পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুর্শিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুকী আজম বীর প্রতীক, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক রাষ্ট্রদূত সুপ্রদীপ চাকমা, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বিধান রঞ্জন রায়, শিক্ষাবিদ ড. আ.ফ.ম খালিদ হাসান, উবিনীগ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদা আখতার, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরজাহান বেগম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, বাণিজ্য, সশস্ত্র, সড়ক ও পরিবহনসহ গুরুত্বপূর্ণ ২৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নিজ হাতে রেখেছেন। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। দারিদ্র্য দূরীকরণে তার ‘ক্ষুদ্রঋণ মডেল’ বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। এর জন্য তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কারও লাভ করেছেন। সম্প্রতি তিনি ‘সামাজিক ব্যবসা’ শীর্ষক নতুন একটি মডেল তৈরি করেছেন, যা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। এশিয়ার মালয়েশিয়া ও ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তা রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত হয়েছে। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানজনক অনেক ডিগ্রি দিয়েছে।

অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি ২০০৫ সালের ২ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০০৯ সালের ৩০ এপ্রিল চার বছরের মেয়াদ পূর্ণ করেন। এই উপদেষ্টা ১৯৯৬ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ অ্যাকাডেমি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট (বার্ড) কুমিল্লার মহাপরিচালক এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া ড. আসিফ নজরুল শিক্ষাবিদ হলেও তিনি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘আর্টিকেল ১৯’ এর সঙ্গে দীর্ঘদিন সম্পৃক্ত ছিলেন।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া আদিলুর রহমান খান মূলত মানবাধিকারকর্মী। তিনি হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন ঘিরে ২০১৩ সালে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেন। এই উপদেষ্টা মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের প্রতিষ্ঠাতা। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হওয়া এই মানবাধিকারকর্মী মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার স্বীকৃতি স্বরূপ রবার্ট এফ কেনেডি মানবাধিকার পদক এবং গুয়াংজু মানবাধিকার পুরস্কার পেয়েছেন।

বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ২০০৯ সালে টাইম ম্যাগাজিনের ‘হিরোজ অব এনভায়রনমেন্ট’ খেতাবপ্রাপ্ত বাংলাদেশি আইনজীবী ও পরিবেশকর্মী। পরিবেশ আইনজীবী হিসেবে বাংলদেশে পরিচিত মুখ। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী। ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আইজেনহাওয়ার ফেলোশিপ করেন সৈয়দা রিজওয়ানা। ঐ বছরই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রথমবারের মতো আয়োজিত ‘পরিবেশ পুরস্কার’-এ ভূষিত হোন তিনি। তার পরিচালিত সংগঠন বেলা ২০০৩ সালে জাতিসংঘের এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম ঘোষিত গ্লোবাল ৫০০ রোল অব অনার্স পুরস্কারে ভূষিত হয়। এছাড়া প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ২০০৯ সালে তিনি পরিবেশের নোবেল খ্যাত ‘গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্টাল প্রাইজ’-এ ভূষিত হন।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া উপদেষ্টা ফরিদা আখতার একজন লেখক, গবেষক ও আন্দোলনকর্মী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়াশোনাকালীন অধ্যাপক ইউনূসকে সরাসরি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন তিনি। সবশেষ এই উপদেষ্টা বেসরকারি সংস্থা উবিনীগের (উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা) নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন আরেক উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যে দায়িত্ব তিনি সরাসরি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এছাড়াও গ্রামীণ পরিবারের একটি অলাভজনক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ শিক্ষার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ সালে যখন তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রকল্প শুরু করেন, তখন তিনি ড. ইউনূসের প্রথমসারির সহযোগীদের একজন ছিলেন।

সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদ বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী হিসেবে কাজ করেছেন। সবশেষে তিনি সমাজ কল্যাণমূলক অধিকারভিত্তিক সংগঠন ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। সংস্থাটি ২০০১ সাল থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিশেষ করে আদিবাসী জনগণের অধিকার আদায়ে কাজ করে আসছে।

দেশের সব মহলের অনেক প্রত্যাশা এই পরিষদকে ঘিরে।